আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসীর: ২য় পর্ব
[সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১-৮২]
التفسير الموجز للقرآن الكريم: الجزء الثاني
سورة البقرة: الآيات (21-82)
< بنغالي- Bengal - বাঙালি>
কতিপয় উলামা
مجموعة من العلماء
সম্পাদক: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
مراجعة: د/ محمَّد منظور إلهي
আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত তাফসির: ২য় পর্ব
সূরা আল-বাকারা
২১ আয়াত থেকে ৮২ আয়াত পর্যন্ত অর্থসহ সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ﴾ [البقرة: ٢١]
২১. হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদাত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।১৭
১৭. একমাত্র আল্লাহর ইবাদত চর্চা ও দাসত্ব মেনে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে পৃথিবীতে অসত্য-চিন্তা, ভুল-দৃষ্টিভঙ্গি ও অসার-অশ্লীল কাজ থেকে মুক্তি, আর পরকালে ব্যর্থ পরিণতি ও আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়।
﴿ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢ ﴾ [البقرة: ٢٢]
২২. যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিযিকস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।১৮
১৮. অর্থাৎ জগতসমূহ ও এতে বিরাজিত সকল উপায়-উপাদানের সৃষ্টি যখন একমাত্র দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা-অনুগ্রহ ও কর্তৃত্বে সম্পন্ন হয়েছে, তখন সৃষ্টির সেরা মানুষের সব বন্দেগী, দাসত্ব ও মুখাপেক্ষিতা নির্দিষ্ট হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহরই জন্য। মানুষ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে মানবে না। অন্য কারও আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান মানবে না; বরং জীবনে সকল ক্ষেত্রে অন্বেষণ করে যাবে একমাত্র আল্লাহর রেজামন্দি, ইবাদত-আরাধনা নিষ্ঠার সাথে নির্দিষ্ট করবে একমাত্র আল্লাহই জন্য। জীবনের সকল স্তর ও ক্ষেত্র সঁপে দিবে আল্লাহর নাযিলকৃত পবিত্র বিধানের হাতে।
﴿ وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِۦ وَٱدۡعُواْ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٢٣ ﴾ [البقرة: ٢٣]
২৩. আর আমি আমার বান্দার ওপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক, তবে তোমরা তার মত একটি সূরা নিয়ে আস।১৯ এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সাক্ষীসমূহকে ডাক; যদি তোমরা সত্যবাদী হও।
১৯. ইতিপূর্বে মক্কায় এ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা হয়েছিল, যদি তোমরা এ কুরআনকে মানুষের রচনা মনে করে থাকো তাহলে এর সমমানের কোনো একটি বাণী রচনা করে আনো। এবার মদীনায় সে একই চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। আরো জানার জন্য দেখুন: সূরা ইউনুস: ৩৮, সূরা হূদ: ১৩, সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮ এবং সূরা তূর: ৩৩-৩৪ আয়াত।
﴿ فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ وَلَن تَفۡعَلُواْ فَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِي وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُۖ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ٢٤ ﴾ [البقرة: ٢٤]
২৪. অতএব যদি তোমরা তা না কর- আর কখনো তোমরা তা করবে না- তাহলে আগুনকে ভয় কর যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর,২০ - যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য।
২০. অর্থাৎ সেখানে শুধুমাত্র সত্যদ্রোহী মানুষই জাহান্নামের জ্বালানী (নরকের ইন্ধন) হবে না বরং তাদের সাথে নিগৃহীত হবে তাদের সে সব উপাস্য নিথর প্রস্তর মূর্তিগুলোও।
﴿ وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ كُلَّمَا رُزِقُواْ مِنۡهَا مِن ثَمَرَةٖ رِّزۡقٗا قَالُواْ هَٰذَا ٱلَّذِي رُزِقۡنَا مِن قَبۡلُۖ وَأُتُواْ بِهِۦ مُتَشَٰبِهٗاۖ وَلَهُمۡ فِيهَآ أَزۡوَٰجٞ مُّطَهَّرَةٞۖ وَهُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٥ ﴾ [البقرة: ٢٥]
২৫. আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। যখনই তাদেরকে জান্নাত থেকে কোনো ফল খেতে দেওয়া হবে, তারা বলবে, ‘এটা তো পূর্বে আমাদেরকে খেতে দেওয়া হয়েছিল’। আর তাদেরকে তা দেওয়া হবে সাদৃশ্যপূর্ণ করে২১ এবং তাদের জন্য তাতে থাকবে পূতঃপবিত্র সঙ্গী-সঙ্গিনী এবং তারা সেখানে হবে স্থায়ী।
২১. জান্নাতবাসীদেরকে যে সব ফল-ফলাদি পরিবেশন করা হবে তা তাদের পরিচিত আকার-আকৃতিরই হবে, তবে নিশ্চিতভাবেই তা হবে স্বাদে-গন্ধে অকল্পনীয়-অতুলনীয়, কারণ সেগুলো তো দুনিয়ার কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ আপ্যায়ন।
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَسۡتَحۡيِۦٓ أَن يَضۡرِبَ مَثَلٗا مَّا بَعُوضَةٗ فَمَا فَوۡقَهَاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَيَعۡلَمُونَ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّهِمۡۖ وَأَمَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِهَٰذَا مَثَلٗاۘ يُضِلُّ بِهِۦ كَثِيرٗا وَيَهۡدِي بِهِۦ كَثِيرٗاۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِۦٓ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٦ ﴾ [البقرة: ٢٦]
২৬. নিশ্চয় আল্লাহ মাছি কিংবা তার চেয়েও ছোট কিছুর উপমা দিতে লজ্জা করেন না। সুতরাং যারা ঈমান এনেছে তারা জানে, নিশ্চয় তা তাদের রবের পক্ষ থেকে সত্য। আর যারা কুফরি করেছে তারা বলে, আল্লাহ এর মাধ্যমে উপমা দিয়ে কী বুঝাতে চেয়েছেন? তিনি এ দিয়ে অনেককে পথভ্রষ্ট করেন এবং এ দিয়ে অনেককে হিদায়াত দেন।২৪ আর এর মাধ্যমে কেবল ফাসিকদেরকেই পথভ্রষ্ট করেন।
২৩. এখানে একটি আপত্তি ও প্রশ্নের উল্লেখ না করেই তার জবাব দেওয়া হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য সুস্পষ্ট করার জন্য মশা-মাছি ও মাকড়শা ইত্যাদির দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। এতে বিরোধীদের আপত্তি উঠেছিল: 'এটা কোন ধরনের আল্লাহর কালাম, যেখানে এসব তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের উপমা দেওয়া হয়েছে?'
২৪. যারা প্রকৃত অর্থে সত্যের প্রতি সমর্পিত হতে প্রস্তুত নয়, আন্তরিকভাবে কথা বুঝতে চায় না, সত্যের মর্ম অনুসন্ধান ও তা মেনে নেওয়া যাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, সমালোচনা করা আর খুঁত বের করাই যাদের কাছে মুখ্য, তাদের দৃষ্টি থাকে কেবল শব্দের বাইরের কাঠামোর ওপর নিবদ্ধ, ফলে তা থেকে এ হতভাগ্যরা অস্পষ্টতা ও বক্রতা উদ্ধার করে সত্য থেকে আরো দূরে সরে যায়।
অপরদিকে যারা সত্য-সন্ধানী, আগ্রহী, যারা মনন ও সঠিক দৃষ্টিশক্তির অধিকারী, তারা আল-কুরআনের ঐ সব বক্তব্যের পরতে পরতে শুভ্র-সুস্পষ্ট জ্ঞানের আলোকচ্ছটা খুঁজে পায়। এ ধরনের দৃষ্টি-উন্মোচনকারী (eye-opener) ও জ্ঞানগর্ভ কথামালার উৎস একমাত্র মহান আল্লাহই হতে পারেন বলে তাদের সমগ্র হৃদয়-মন সাক্ষ্য দিয়ে উঠে।
﴿ ٱلَّذِينَ يَنقُضُونَ عَهۡدَ ٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ مِيثَٰقِهِۦ وَيَقۡطَعُونَ مَآ أَمَرَ ٱللَّهُ بِهِۦٓ أَن يُوصَلَ وَيُفۡسِدُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٢٧ ﴾ [البقرة: ٢٧]
২৭. যারা আল্লাহর সুদৃঢ় অঙ্গীকার ভঙ্গ করে,২৫ এবং আল্লাহ যা জোড়া লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে২৬ এবং যমীনে ফাসাদ করে;২৭ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।
২৫. এখানে সৃষ্টির সূচনাতেই সমগ্র মানবাত্মার কাছ থেকে গৃহীত একমাত্র মহান আল্লাহর আনুগত্য করার অঙ্গীকার পূরণের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার উল্লেখ রয়েছে এখানে:
"আর (স্মরণ করো), যখন তোমাদের প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদেরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্পর্কে স্বীকৃতি আদায় করলেন (বললেন): 'আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই'? তারা বললো: 'হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিলাম'। (এটি এ জন্য) যেনো তোমরা পুণরুত্থানের (কিয়ামতের) দিন একথা বলতে না পার যে, 'আমরা তো এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলাম'!" (সূরা আল আ’রাফ: ১৭২)
২৬. এ সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে রয়েছে অর্থের অশেষ ব্যাপকতা। যেসব সম্পর্ককে শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত রাখার ওপর নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক কল্যাণ, আল্লাহ তা‘আলা সেগুলোকে ত্রুটিমুক্ত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
যুবাইর ইবন মুতইম (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী (সা:)-কে বলতে শুনেছেন: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। -- সহীহ আল বুখারী, ৫ম খন্ড, হাদীস নং- ৫৫৪৯।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: অপরিহার্য সম্পর্কগুলোর প্রয়োজনীয় পরিচর্যা ও যত্ন না নিয়ে অহেতুক সম্পর্ক গড়ে তোলা মু’মিনের জন্য কখনো উচিত নয়। বিশেষ করে যাদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা ইসলামে নিষিদ্ধ; যেমন ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু, তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক-চর্চা অবশ্যাই বর্জনীয়।
সম্পর্ক-চর্চার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা জরুরি। তা হলো, বন্ধু-বান্ধবের সম্পর্ককে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে, আত্মীয়-স্বজনদেরকে ভুলে যাওয়া, আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্ককে যথার্থরূপে পরিচর্যা না করা মারাত্মক অপরাধ। যারা এরূপ করে, তারা, উক্ত আয়াতের ভাষ্যানুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল।
২৭. এ তিনটি বাক্যের মাধ্যমেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যকার অঙ্গীকার কর্তন করা এবং মানুষে-মানুষে যে সম্পর্ক পরিচর্যার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করা এবং জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করার অনিবার্য পরিণতি হলো বিপর্যয়।
﴿ كَيۡفَ تَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَكُنتُمۡ أَمۡوَٰتٗا فَأَحۡيَٰكُمۡۖ ثُمَّ يُمِيتُكُمۡ ثُمَّ يُحۡيِيكُمۡ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٨ ﴾ [البقرة: ٢٨]
২৮. কীভাবে তোমরা আল্লাহর সাথে কুফরী করছো অথচ তোমরা ছিলে মৃত? অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জীবিত করেছেন। এরপর তিনি তোমাদেরকে মৃত্যু দেবেন অতঃপর জীবিত করবেন। এরপর তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।২৮
২৮. এ আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে নিচের আয়াত দু'টির বক্তব্য লক্ষণীয়:
যারা কাফির (আল্লাহকে অস্বীকারকারী), তাদেরকে (শেষ বিচারের দিন) বলা হবে: 'আজ তোমাদের (পরিণতি দেখে) নিজেদের প্রতি তোমাদের যে কঠিন ক্রোধ অনুভূত হচ্ছে, তার চেয়ে আল্লাহ তোমাদের প্রতি আরো অধিক ক্রুদ্ধ হতেন, যখন তোমাদেরকে (দুনিয়ায়) ঈমান আনতে বলা হতো, আর তা তোমরা অস্বীকার করতে'! তারা বলবে: 'হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদের দু'বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু'বার জীবন দিয়েছেন। এখন আমাদের অপরাধগুলো স্বীকার করে নিচ্ছি। এখনও নিষ্কৃতির কোনো উপায় আছে কি'? [দেখুন: সূরা আল-মু'মিন, আয়াত: ১০-১১]
﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰٓ إِلَى ٱلسَّمَآءِ فَسَوَّىٰهُنَّ سَبۡعَ سَمَٰوَٰتٖۚ وَهُوَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ٢٩ ﴾ [البقرة: ٢٩]
২৯. তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আসমানের প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাকে সাত আসমানে২৯ সুবিন্যস্ত করলেন। আর সব কিছু সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাত।৩০
২৯. সাত আকাশের তাৎপর্য কি? সাত আকাশ বলতে কি বুঝায়? এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন। মানুষ প্রতি যুগে যুগে আকাশ বা অন্য কথায় পৃথিবীর বাইরের জগত সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণ ও ধারণা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিভিন্ন চিন্তা ও মতবাদের অনুসারী হয়েছে। এ চিন্তা ও মতবাদগুলো বিভিন্ন সময় বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই এর মধ্য থেকে কোনো একটি মতবাদ নির্দিষ্ট করে তার ভিত্তিতে কুরআনের এ শব্দগুলোর অর্থ নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। তবে সংক্ষেপে এটুকু বুঝে নেওয়া দরকার যে, সম্ভবত পৃথিবীর বাইরে যতগুলো জগত আছে সবগুলোকেই আল্লাহ তা‘আলা সাতটি সুদৃঢ় স্তরে বিন্যস্ত করে রেখেছেন অথবা এ বিশ্ব-জগতসমূহের যে স্তরে পৃথিবীর অবস্থিতি সেটি সাতটি স্তর সমন্বিত।
৩০. এখানে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে:
ক. যে আল্লাহ আমাদের সব ধরনের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ডের খবর রাখেন এবং যাঁর দৃষ্টি থেকে আমাদের কোনো কার্যক্রমই গোপন থাকতে পারে না, তাঁর মোকাবিলায় মানুষ অস্বীকৃতি ও বিদ্রোহের পথ বেছে নেওয়ার সাহস কী করে করতে পারে?
খ. যে আল্লাহ যাবতীয় সত্য জ্ঞানের অধিকারী ও প্রকৃত উৎস, তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অগ্রসর হলে অজ্ঞতার অন্ধকারে পথভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কী পরিণতি হতে পারে?
﴿ وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَجۡعَلُ فِيهَا مَن يُفۡسِدُ فِيهَا وَيَسۡفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَۖ قَالَ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٠ ﴾ [البقرة: ٣٠]
৩০. আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে একজন খলীফা সৃষ্টি করব,৩১ তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে?৩২ আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি? ৩৩ তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান না।৩৪
৩১. খলীফা বলতে এখানে পৃথিবীকে কর্ষণ-চাষাবাদ ও পৃথিবীতে থাকাবস্থায় স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে আল্লাহর দাসত্ব ও ইবাদত চর্চার ক্ষেত্রে প্রজন্মান্তরে একে অন্যের প্রতিনিধি হওয়া। কারও কারও মতে জিন্ন জাতি আল্লাহর ইবাদত চর্চায় ব্যর্থতার পরিচয় দেয়ার পর আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর কর্ষণ-চাষাবাদ ও স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে ইবাদত চর্চার জন্য জিন্নদের স্থলাভিষিক্তরূপে মানবপ্রজাতিকে সৃষ্টি করেছেন।
মানুষ আল্লাহর খলীফা ঠিক এমনভাবে বলা উচিত নয়। কেউ মারা গেলে অথবা পদত্যাগ করলে তার জায়গায় যে আসে তাকেই মূলতঃ খলীফা বলা হয়। আর আল্লাহ যেহেতু চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর এবং তিনি কখনো তার চেয়ার অন্যের জন্য ছেড়ে দেবেন না তাই মানুষ আল্লাহর খলীফা অভিধানের এ ব্যবহার সালাফদের অধিকাংশ আলেমের নিকট অনুচিত।
৩২. এটি ফিরিশতাদের ভিন্নমত পোষণের বহিঃপ্রকাশ নয় - এর শক্তিই তাদের নেই, বরং তা ছিল মহান আল্লাহর দরবারে তাদের জিজ্ঞাসা। মূল কথা হলো, 'খলীফা' হিসেবে যার সৃষ্টি, তাকে কিছু স্বাধীন কর্তৃত্বও দেওয়া হবে, তার থাকবে কিছু ইচ্ছার স্বাধীনতা - যা হতে পারে গোলযোগ ও বিশৃংখলার কারণ - এ ধারণাটির স্পষ্টকরণের জন্যই ছিল তাদের আবেদন।
৩৩. ফিরিশতাদের এ কথার মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা এবং তাঁর সব নির্দেশ যথাযথভাবে পালনে তাদের কোনো অসম্পূর্ণতা রয়েছে কিনা, যার ফলে খলীফা সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, বিনীতভাবে বিষয়টি আল্লাহর দরবারে পেশ করা।
৩৪. এটি ফিরিশতাদের দ্বিতীয় সন্দেহের জবাব। খলীফা প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন, তারা জানে না। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখেই পৃথিবীতে এমন এক প্রজাতি সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়েছে যাদেরকে দেওয়া হবে সীমিত ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা, যার ফলে তারা হবে ফিরিশতাদের চেয়েও অনেক সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ ও প্রতিদানপ্রাপ্য।
﴿ وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبُِٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١ ﴾ [البقرة: ٣١]
৩১. আর তিনি আদমকে নামসমূহ৩৫ সব শিক্ষা দিলেন, তারপর তা ফিরিশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’।
৩৫. কোনো বস্তুর নামের মাধ্যমে মানুষ সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে থাকে। তাই সর্বপ্রথম সৃষ্ট মানুষ আদমকে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দেয়ার মানেই হলো তাঁকে সব ধরনের বস্তুর জ্ঞান দান করা হয়েছিল।
﴿ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ ٣٢ ﴾ [البقرة: ٣٢]
৩২. তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। ৩৬ নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’।
৩৬. এখানে ধারণা হয় যে, প্রত্যেক ফিরিশতার এবং তাদের প্রত্যেকটি শ্রেণীর জ্ঞান তাদের কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেমন বায়ু-প্রবাহের ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের উদ্ভিদজগত সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। অন্যান্য বিভাগে নিয়োজিতদের অবস্থাও তাই। তবে অবশ্যই মহান আল্লাহ সঠিক জানেন। অথচ মানুষকে দেওয়া হয়েছে ব্যাপকতর জ্ঞান, তাদের রয়েছে উদ্ভাবনী (innovative), প্রাসঙ্গিক (correlative), প্রায়োগিক (implementing) ও সমন্বয় (coordination) জ্ঞানসহ অমিত সৃজনশীল প্রতিভা। তাই তো তারা বিবেকসম্পন্ন, সীমিত-স্বাধীন, অথচ দায়বদ্ধ ও সৃষ্টির সেরা। ফলে তাদের রয়েছে একদিকে সম্মান ও পুরস্কার অথবা অন্যদিকে শাস্তি ও চরম অপমান; আর ফিরিশতাদের তা নেই, কারণ তাদের আছে নিয়ন্ত্রিত, সুনির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ জ্ঞান এবং দায়িত্ব; পাশাপাশি নেই অস্বীকার ও সীমালংঘনের কোনো ক্ষমতা।
﴿ قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئۡهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَأَعۡلَمُ مَا تُبۡدُونَ وَمَا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٣٣ ﴾ [البقرة: ٣٣]
৩৩. তিনি বললেন, ‘হে আদম, এগুলোর নাম তাদেরকে জানাও’। সুতরাং যখন সে এগুলোর নাম তাদেরকে জানাল, তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ ও যমীনের গায়েব জানি এবং জানি যা তোমরা প্রকাশ কর এবং যা তোমরা গোপন করতে’?৩৭
৩৭. আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক সবকিছুর নাম বলে দেয়ার এ মহড়াটি ছিলো ফিরিশতাদের প্রথম সন্দেহের জবাব। তাদের উপস্থাপনাটি ছিলো: 'আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, যে সেখানে অশান্তি ও রক্তপাত ঘটাবে'? [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩০]
এখানে ব্যাপারটি এরূপ যে, আল্লাহ তা'আলা ফিরিশতাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি আদমকে শুধুমাত্র ইচ্ছার স্বাধীনতাই দেননি, তাকে দিয়েছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আর খলীফা সৃষ্টির সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ। বিপর্যয়ের দিকটির তুলনায় এ কল্যাণের গুরুত্ব ও মূল্যমান অনেক বেশি।
﴿ وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ وَٱسۡتَكۡبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٤ ﴾ [البقرة: ٣٤]
৩৪. আর যখন আমি ফিরিশতাদেরকে বললাম, ‘তোমরা আদমকে সিজদা৩৮ কর’। তখন তারা সিজদা করল, ইবলীস ছাড়া।৩৯ সে অস্বীকার করল এবং অহঙ্কার করল। আর সে হল কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।
৩৮. ফিরিশতাদেরকে মানুষের সামনে নত হবার নির্দেশটির মর্মার্থ হলো: পৃথিবীর সকল কিছু মানুষের অধীনস্থ করে দেয়া। কেননা ফিরিশতাগণ আল্লাহর নির্দেশে মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয় পরিচর্যা ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আর এ ফিরিশতাগণকেই যখন আল্লাহ তা‘আলা আদমের সামনে নত হতে বললেন তার অর্থ এ মহাবিশ্বের সকল কিছুকেই মানুষের অধীনতা স্বীকার করিয়ে নেওয়া হলো।
৩৯. এখানে একটি প্রশ্ন: ইবলীস একজন জিন্ন আগুনের তৈরী; [সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১৫; সূরা আল-হিজর, আয়াত: ২৭] হয়ে ফিরিশতাদের (আলোর তৈরী) প্রতি আল্লাহর নির্দেশের আওতায় এল কী করে?
এর ব্যাখ্যা হলো: সে আল্লাহর ইবাদত করতে করতে ফিরিশতার মর্যাদা লাভ করে। তাই সেও ছিলো ঐ নির্দেশের আওতাধীন। তাছাড়া সে নিজেই ঐ আদেশ অমান্যের কারণে একথা বলেনি যে, সে তো একজন জিন্ন, ফিরিশতা না; বরং সে সুস্পষ্টভাবে করেছে অহংকার ও শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই। [সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১২]
তাছাড়া আরেকটি ব্যাপার হলো: আসলে ফিরিশতাদের আল্লাহর নির্দেশ না মানার কোনো শক্তি নেই। [দেখুন, সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬ ও সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫০], আর জিন্নদের সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলেই ইবলীস তা অমান্য করার দুঃসাহস করেছে।